প্রাচীন যুগে মানুষ যখন কথা বলতে জানত না তখন মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য বিভিন্ন দেহভঙ্গির সাহায্যে নিত। প্রাথমিক স্তরের আকার ইঙ্গিত থেকে উচ্চারণ, তারপরে ভাষা,অনেক পরে ভাষার লিখিত রুপ এসেছে। মানুষের ভাষা সভ্যতার বিভিন্ন স্তর অতিক্রমে বা রুপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে নৃত্যকলা প্রাথমিক কালে ভাষার উদ্ভাবনের এক বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখে। মানুষের বিভিন্ন দেহভঙ্গির আকার ইঙ্গিত এককালে মনের ভাব প্রকাশের প্রধান অবলম্বন হয়ে ছিল।সেকাল আমরা বহু পূর্বেই অতিক্রম করে এসেছি। সেই চিহ্নিত পথ পরিক্রমায় আজকের আধুনিক যুগের মানুষ আমরা। নৃত্যকলার এই ভাব প্রকাশের প্রবল স্পৃহা আকরিত হয়ে প্রাচীনকাল থেকেই ইতিহাসের নিরবিচ্ছিন্ন গতিপথে সভ্যতার তটরেখায় এক এক মাইল ফলক রুপে তৎকালীন সময়ে আলোক স্তম্ভ হয়ে আছে। কালের স্রোতধারায় নৃত্যকলা আজ স্ব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। নৃত্যকলা আজ ললিত কলার এক স্বকীয় ঐর্শ¦য্যময় অফুরন্ত ভান্ডার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ঘারানার নৃত্য বিরাজমান। জাতি, ভাষা ভেদে নৃত্যের ঘারানা তৈরি হয়েছে। যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরে এই নৃত্যকলার চর্চা করে আসছে নারীÑপুরুষ উভয়েই। নাচ করতে ভালোবাসে না এমন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন। শুধু মানুষ নয় সকল প্রানী মনের আনন্দ প্রকাশের জন্য নিজস্ব ভংগীমায় নেচে উঠে। নৃত্যকলা তার স্ব মহিমায়,স্ব গুনে প্রতিটি প্রানীর অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। ঠিক তেমনি পুরুষ রুপান্তরকামী মানুষদের অন্তরে একটু বেশি মাত্রায় জায়গা করে নিয়েছে নাচ। যেসকল মানবশিশু শারিরিক ভাবে ছেলে সন্তান হয়ে জন্ম গ্রহন করেছে কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে তাদের মনে হয় তারা একটি ভুল শরীরে প্রবেশ করেছে তাদেরকেই বলা হয় পুরুষ রুপান্তরকামী মানুষ। এই ব্যাক্তিরা নিজেদের মনে,প্রানে, সম্পুর্ন রুপে নারী বলে মনে করে কিন্তু দেহ যেহেতু পুরুষ তাই জগতের কাছে তারা পুরুষ জাতী বলেই পরিচিত হয়। এই মানুষদের মধ্যে একতৃতীয়াংশ জনই নাচ করতে ভীষন রকম ভালোবাসে, সাজতে পছন্দ করে তাই বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় মেকাব আর্টিস, ফ্যাশান ডিজাইনার, নৃত্যকলা এই ক্ষেত্রগুলোকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।তাই বলে যারাই এই পেশায় আছে তারা সবাই রুপান্তর কামী মানুষ এটা নয় আবার এই ব্যাক্তিরা অন্যকোন পেশায় নিয়োজিত হয়না এটাও নয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পেশায় আসতে তারা পছন্দ করেন। পৃথিবীর সব জায়গায় সব পেশায় তারা দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। যেহেতু নৃত্যকলা পেশাটা তাদের বেশী পছন্দের তাই বর্তমানে পুরুষ নৃত্যশিল্পীর অর্ধেকই হলেন রুপান্তর কামী মানুষ। এবার এই ব্যাক্তিরা যখন অন্য পেশায় কাজ করেন তখন কিন্তু সমাজ ভুল করেও ঐ পেশাকে দোষ দেয় না, বলে না দেখ এতো মুদির দোকানদার বা এতো প্লেন চালায় তাই এ নারী সুলভ আচরণ করে। কিন্তু যখন নৃত্যশিল্পী হয় তখন সমাজ কোন কিছু চিন্তা না করেই বলে দেয় ওতো নাচ করে তাই মেয়েলী হয়ে গেছে। কোন কিছু বিচার বিবেচনা না করে, না ভেবেই সব দোষ নৃত্যকলার উপর চাপিয়ে দেয়। আদোতে কি নৃত্যকলা এতো ক্ষমতাশালী ? যে কোন মানুষের অন্তরকে লিঙ্গ পরির্বতনের মানষিকতার মতো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে ? এটা কি সম্ভব ? শাস্ত্রীয় নৃত্যকলাকে বলা হয় দেব দেবতাদের নাচ।
ADDVERTISE HERE 728 x 90 1
দেবতারা পুরুষ ছিলেন তাই নাচ করলে যদি কোন পুরুষ মেয়েলী স¦ভাবের হয় তবে সবার প্রথম তো দেবতাদেরই মেয়েলী স্বভাবের আচরণ করা উচিত ছিল। যদিও দেব দেবতাদের কাহিনী আমরা শুধুমাত্র শাস্ত্রে পরেছি তাদের দেখিনি কখনও। কোন শাস্ত্রে লেখা নেই যে কোন দেবতা নাচ করতে করতে মেয়েলী আচরণ করতেন । যদি তাই হতো তবে সবার আগে মহাদেব শিবের নাম আসতো কেননা তিনি হলেন নটরাজ, যাকে পুরুষ শ্রেষ্ঠ বলা হয়। পৃথিবীতে যত পুরুষ নৃত্যশিল্পী আছেন তারা সবাই তবে মেয়েলী স্বভাবের হয়ে যেত যদি নাচের এত ক্ষমতা থাকত। এই দোষারোপটা বিশেষ করে শাস্ত্রীয় নৃত্য এবং লোকো নৃত্যকে করা হয়। এই দুই ঘারানার নাচ করলেই ছেলেদের আচরণের পরির্বতন হয়। এটা কতটুকু সত্য ? একটু পর্যালোচনা করা যাক, নৃত্যকলা হলো গুরুমুখী বিদ্যা। যখন একজন রুপান্তর কামী মানুষ নৃত্যশিল্পী হয় তখন তার স¦ভাবগত কারণে মেয়েলী ঢঙ্গে লাস্য আঙ্গিকে সে নাচ করতে ভালোবাসে এবং পরর্বতিতে তিনি যখন গুরু হয়ে উঠে তখনও তিনি তার শিক্ষার্থীদের একই রকম নাচ শিখাতে শুরু করেন। তাতে করে যা হয় তা হলো যেসকল ছেলে শিক্ষার্থী যায় তার কাছে নৃত্য শিক্ষা গ্রহন করতে তারা যদি রুপান্তর কামী নাও হয় তবুও গুরুকে অনুকরণ করতে করতে তাদেরও স্বভাবের পরির্বতন ঘটে। এবার প্রশ্ন হলো এক্ষেত্রে সমাজ কাকে দোষী বলবে ? নাচকে নাকী গুরুকে ? এই বিচারের ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। গুরু যদি সঠিক শিক্ষা প্রদান করে তবে ছেলেরা লোকো নৃত্য বা শাস্ত্রীয় নৃত্য করলে তাদের পুরুষালী স্বভাব আরো সমৃদ্ধশালী হয় তা আমরা আর্ন্তজাতিক নৃত্যগুরু এবং নৃত্যশিল্পী সি বি চন্দ্রশেখর গুরুজীকে দেখলেই বুঝতে পারি। তাছাড়াও অনেক নৃত্যগুরু আছেন যাদের ব্যাক্তিত্ব দেখলে মুগ্ধতায় মন ভরে যায়। তাই আমার ছেলে শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখলে মেয়েলী হয়ে যাবে এই কথা বলার আগে একটু ভেবে বলা ভালো আর যে গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহন করতে যাচ্ছে তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তারপর পাঠানো উচিত। তবেই তো বুঝা যাবে দোষটা কার ? নাচ করলে কেউ মেয়েলী হয় না, কেউ মেয়েলী হলে সে নাচ করতে ভালোবাসে । তাই নৃত্যকলাকে দোষারোপ করার আগে একটু ভেবে দেখা উচিত নৃত্যকলা দোষী কিনা। যখন অন্য ভুবনের মানুষের মুখে তাচ্ছিলের সুরে এই কথাটি বেরিয়ে আসে তখন স্ব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই ললিত কলা মুচকি হেসে বলে,“ যে আমায় ভুল বুঝেছে সে যে নিজেরই অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে।”