জ্ঞান হবার পর থেকে সমাজ সংসারের কিছু নিষেধাজ্ঞার উপর আমার প্রশ্ন রয়ে গেছে যার উত্তর আমি ত্রিশ বছর বয়সে এসেও খুঁজে চলেছি তার মধ্যে একটি প্রশ্ন হলো উত্তরহস্ত। মানব দেহের বাম হাত। বাল্যকাল থেকেই শুনতে হয়েছে, বাম হাত দিয়ে কাউকে কিছু দিতে নেই বিশেষ করে বড়দের। তবে নাকি যাকে দেয়া হচ্ছে তাকে অসম্মান করা হয়। বাম হাত দেখিয়ে কথা বলতে নেই, এই হাত দিয়ে খেতে নেই, এই হাত বাড়িয়ে কাউকে সম্মোধন পর্যন্ত করা যাবে না এমনকি রেগে গিয়ে যদি ডান হাত দিয়ে অন্যকে চড় মারে তবে পরর্বতীতে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করা যায় কিন্তু বাম হাত দিয়ে মারলে তা ক্ষমার অযোগ্য হয়ে পড়ে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম সেখানে দেশের গানের উপর নাচ করতে হয়েছিল আমাদের। ঐ নাচে কোরিওগ্রাফির জন্য তিনজনকে বাম হাতে পতাকা ধরতে বলেছিলাম। সেই কথা যত দিন আমি জীবিত থাকবো তত দিন মনে যতœ করে রেখে দেবো। তার কারণ হলো বাম হাত দিয়ে পতাকা ধরাতে পতাকার অসম্মান করা হয়েছে আর পতাকার অসম্মান মানে হলো দেশের অসম্মান। সেই কারণে সকলের এবং দেশের সম্মান বজায় রাখতে আমাকে কোরিওগ্রাফি পরির্বতন করে ডান হাতে পতাকা দিতে হয়েছিল।
অনেকের ভাষ্য মতে বাম হাত হলো অশুভ, আবার অনেকে না জেনে অন্যের গতানুগতিক শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এখন প্রশ্ন হলোÑবাম হাত যদি সত্যিই অশুভ একটি হাত হয় তবে সৃষ্টিকর্তা জেনে বুঝে এই অশুভ অঙ্গটি মানব দেহে কেন দিয়েছেন। এই কথাটি কখনো ভেবে দেখেছেন কি? মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গ, প্রতঙ্গ, উপাঙ্গ একে অপরের পরিপূরক। একটু ভেবে দেখুন তো বাম হাত ব্যবহার না করে আপনাকে সবকিছু করতে হচ্ছে আপনার কি খুব সুবিধা হবে তখন? না ভালো লাগবে? পরীক্ষামূলক আজই এই কাজটা করে দেখুন যদি আপনার খুব সুবিধা হয় তবে তো হয়েই গেলো আর কথা বলার প্রয়োজন নেই কিন্তু তা যদি না হয় তবে খানিকক্ষণ চিন্তা করে দেখুন তো যে হাত দিয়ে আপনি সকল প্রকার সুবিধা গ্রহণ করছেন, সকল প্রকার কাজ করাচ্ছেন, এমনকি শৌচালয়ে গিয়েও এই হাতের ব্যবহার করছেন, সেই প্রয়োজনীয় হাতকে আপনি নিজেই আবার অশুভ বলে আখ্যা দিচ্ছেন, কেন? শুধুমাত্র এই হাতটি শৌচালয়ে ব্যবহার করা হয় বলে নাকি আরও অন্যও কোন কারণ আছে? যদি শৌচালয়ে ব্যবহার হয় এই কারণ থাকে বাম হাতকে অশুভ বলে অপমান করার তবে কি মানুষ এই হাত রান্না করার সময় রান্নার কাজে ব্যবহার করে না? অন্যকে খাবার পরিবেশন করার সময় বাম হাতের সাহায্য নেয় না? যে অঙ্গটির কাছ থেকে মানুষ সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে চলেছে আমৃত্যু পর্যন্ত সেই অঙ্গটিকেই অপমান, অসম্মান, অবহেলা করবার কারণ আজ পর্যন্ত আমার বোধোগম্য হয়নি। যে মানুষ বন্দুক হাতে দেশ স¦াধীন করার মতো মহৎ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি কি শক্র পক্ষকে আক্রমণ করার সময় শুধুমাত্র ডান হাত ব্যবহার করেছিলেন-বাম হাতের প্রয়োজন পড়েনি বুঝি, যদি ডান-বাম উভয় হাতের ব্যবহার করে দেশ থেকে শত্রæ পক্ষকে পরাজিত করা হয় তবে পতাকা ধরবার অধিকার শুধু ডান হাতকেই দেয়া হবে কেন বাম হাতকে বঞ্চিত করার অর্থ কি?
যারা ঈশ্বরের অস্তিতে বিশ্বাসী তাদের উদ্দেশ্যে বলচ্ছি-ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতা এবং সর্বময় জ্ঞানের অধিকারী বলে যদি তারা মেনে থাকেন তবে ঈশ্বর কি বলেছেন মানবদেহের এই অংশটি অশুভ। কোন র্ধমগ্রন্থে এই কথা লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। বিজ্ঞান বলে মানবদেহের সাধারণত একপাশ অন্যপাশের তুলনায় একটু বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে সেইসূত্র অনুযায়ী শতকরা ৯০% মানুষের বাম পাশের তুলনায় ডান পাশের কর্মক্ষমতা বেশি তাই মানুষ সবকিছুতে ডান হাতের ব্যবহার বেশি করে কিন্তু তাই বলে এই নয় যে বাম হাত অশুভ, অপয়া কোন অঙ্গ। বাকি ১০% মানুষ যারা বাহাতি হয় তাহলে তাদের কি বলা উচিৎ নয় যে ডান হাত অশুভ। তর্কের প্রয়োজনে যদি তারা বলেও তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা তাদের হাসির খোরাক বানাতে পিছ পা হবেনা কখনই, ঠিক যেমন আমাকে এখন বলছেন আপনারা যারা আমার এই লেখা পড়ছেন।
শিশুকাল থেকেই আমি সকলের হাসি এবং বিরক্তির কারণ তাই এটা নিয়ে আর ভাবি না কেননা আমি এত বছরে এটা বুঝে গেছি যে, যাদের আমার প্রশ্নের জবাব দেবার মতো ক্ষমতা বা জ্ঞান নেই তারা নিজেদের অজ্ঞতা লুকানোর জন্য অন্যকে উপহাস করে, প্রকৃত পক্ষে এতে করে সেই ব্যক্তি যে নিজেকেই অজ্ঞতার কাতারে নিয়ে গেছে এটা বুঝার মতন বোধটুকুও নেই তাদের। যাইহোক এবার কিছু বাম হাত ব্যবহারকারী মানুষের কথা বলি। একজন ধর্মীয় যাজক, যিনি জন্ম নিয়েছিলেন বাম পাশের কর্মক্ষমতা নিয়ে উনি বাংলাদেশের এক ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যদিও সেইগ্রাম এখন প্রায় শহরে পরিণত হচ্ছে কিন্তু ১৯৭১ সালের পূর্বের সময়ে ওটা একটা অজপাড়াগা ছিল। সেই যাজকের সাক্ষ্য থেকে শোনা কিছু কথা আপনাদের বলতে চাই, তিনি সবকিছুতে বাম হাত ব্যবহার করত বলে তাকে শিশুকাল থেকেই নানা রকম শারীরিক, মানুসিক র্নিযাতনের শিকার হতে হয়েছে বিশেষ করে তার বাবার কাছ থেকে। তাকে ডান হাত দিয়ে লেখানো, ডান হাত দিয়ে খাবার খাওয়া শেখানোর পরেও যখন সে তার বাম হাতের ব্যবহার করতো তখন তাকে মারপিট থেকে শুরু করে খাবার বন্ধ করে দেয়া হতো একদিন নাকি তাকে বাঁশের কাঁচা কঞ্চি দিয়ে মেরে সারাদিন ঘরের খুঁটির সাথে বাম হাত বেধে রেখেছিলেন এবং কিছু খেতে দেয়নি রাত পর্যন্ত তার বাবা। এটাতো গেল উনবিংশ শতাব্দীর মানুষের চিন্তা ভাবনার কথা এবার বলব বিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষের চিন্তার পরির্বতন ঘটেনি তার আরও একটি গল্প।
ADDVERTISE HERE 728 x 90 1
২০০১ সাল, আমি তখন ঢাকার র্ফামগেট মনিপুরি পাড়ার একটি হোস্টেলে থাকি আমার রুমমেট ৪ জন ছিল তার মধ্যে একজনের নাম ছিল রিমা ওকে আমি খুব পছন্দ করতাম রিমা ছিল বাহাতি। রিমা তার সমস্ত কাজ সম্পন্ন করত বাম হাত দিয়ে, একদিন খুব কষ্ট নিয়ে বলছিল ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত ওকে কত অপমান আর হাসির পাত্র হতে হয়েছে শুধুমাত্র বাম হাত ব্যবহার করে বলে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে আমাদের সমাজের মানুষের মানসিকতা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে তার কোন পরির্বতন নেই। ২০২৩ সালে এসেও এই চিন্তা ভাবনা থেকে যখন মানুষের মুক্তি মিলছে না তখন আমার মনে হলো একটু লেখা প্রয়োজন, আমার লেখা পড়ে যদি কারো মনে একটু নতুন ভাবনার জন্ম নেয় এবং বাম হাতের প্রতি ভালোবাস সৃষ্টি হয় তাহলেই আমার সেই মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে যারা বাম হাতের কর্মক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। এই শতাব্দিতে যখন শিক্ষায়, সংস্কৃতি, তথ্য-প্রযুক্তিতে সমাজ এতো এগিয়ে আছে, তখন মধ্যযুগের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ। শুধুমাত্র বিদ্যান হলেই কেউ জ্ঞানী বা মুক্ত চিন্তার মানুষ হয় না। জ্ঞানী এবং মুক্ত মনের অধিকারি হতে হলে সমাজের গতানুগতিক চিন্তার পরির্বতন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। যতক্ষণ না মানুষ নিজের ভেতরের মানুষকে ঠিক করতে না পারবে ততক্ষণ কোন কিছুই পরির্বতন করা সম্ভব না। তবে আমি এটুকু নিশ্চিত আজ আমার লেখার কেউ মূল্য না দিলেও এমন একদিন আসবে যেদিন সমাজে আমার এই লেখার মূল্যই বেশি থাকবে। সেদিন মানব দেহের দুই হাত সমান সম্মানে সম্মানিত হবে।
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক
অরুণোদয় (শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)
খুলনা, বাংলাদেশ।